ট্রেন দুর্ঘটনায় দায়ী কর্মকর্তার ক্ষমতার দাপটে সপ্তাহ শেষে পদোন্নতি

Samsuddin Chowdhury    |    ০১:০১ পিএম, ২০২০-০৭-২৬


ট্রেন দুর্ঘটনায় দায়ী কর্মকর্তার ক্ষমতার দাপটে সপ্তাহ শেষে পদোন্নতি

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ গত ৪ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) থেকে শহর অভিমুখে ছেড়ে যাওয়া শাটল ট্রেনের সঙ্গে মালবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭০ শতাংশ দায়ী হয়েও অদৃশ্য ক্ষমতার বলয় ব্যাবহার করে বহাল তবিয়তে আছেন স্টেশন মাস্টার গ্রেড-৩ জাফরুল্লাহ মজুমদার। শুধু তাই নয় পদোন্নতিও পেয়েছেন তিনি। জানা যায় দায়িত্বের অবহেলার কারণে দুর্ঘটনায় দায়ী প্রমাণিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নী তার বিরুদ্ধে। এমনকি সপ্তাহ শেষে গত ১১ মার্চ পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট এর অনুমোদনে জুনিয়ার পার্সোনেল অফিসার-২ এর স্বাক্ষরিত এক আদেশে জাফর উল্লাহকে একই স্টেশনে ভারপ্রাপ্ত থেকে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ত্বও দেওয়া হয়। 

অভিযোগ আছে দীর্ঘদিন ধরেই জাফর উল্লাহ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেই বেতন ভাতা নিচ্ছে। এমনকি তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটির সদস্যরা বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাকে পাইনি। পরে বেলা ১২ তার দিকে ইউনিফর্ম বিহীন অবস্থায় পাঞ্জাবি পড়ে ঘটনাস্থলে আসেন তিনি। সুপারভাইজিং স্টেশন মাস্টার হিসেবে স্টেশন আঙিনায় তার ডিউটি প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে ৪টা পর্যন্ত হলেও তিনি আসেন বেলা ১২ টায়। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় তিনি যদি ঘটনার দিন সকাল ৮ টার দিকে স্টেশনে আসতেন তাহলে শাটল ট্রেনের লাইন ক্লিয়ার দেওয়ার পর অন ডিউটি স্টেশন মাস্টার সুপার ভাইজিং স্টেশন মাস্টার হিসেবে তার সাথে পরামর্শ করে মালবাহী ট্রেনের সান্টিং মুভমেন্ট না দিলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। তাই স্টেশন মাস্টার জাফর উল্লাহ মজুমদারের দায় স্পষ্ট। 

চলতি বছরের মার্চ মাসের ৪ তারিখে ষোলশহর জংশন স্টেশন ক্যান্টনমেন্ট সাইডে ডাউন হোম সিগন্যাল পোস্টের কাছে ১৩৪ নং ডাউন ট্রেনের ইঞ্জিন নং ২৭২০ এর সঙ্গে বোল্ডার স্পেশাল-১ এর ইঞ্জিন নং ২২২৮ এর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় আহত হয় মালবাহী ওয়াগনের লোকোমাস্টার শেখ আবদুল্লাহ হিল বাকি এবং শাটল ট্রেনে থাকা পুলিশ সদস্য মিজান ও শরীফ। 

পরে ডিটিও/চট্টগ্রাম ওমর ফারুককে আহবায়ক করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে রেল কর্তৃপক্ষ। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন ডিইএন-১/চট্টগ্রাম এএমই/আইসি/চট্টগ্রাম ডিএসটিই/চট্টগ্রাম। 

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ডিটিও ওমর ফারুকের সাথে কথা হলে তিনি প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে জানান ইতিমধ্যে স্টেশন মাস্টার জাফর উল্লাহ ও তান্নি বড়ুয়াকে দুর্ঘটনার কারণ দর্শানোর জন্যে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। 

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনাস্থল, দুর্ঘটনার ধরন, কর্তব্যরত কর্মচারীদের লিখিত ও মৌখিক জবানবন্দি সহ সকল আনুষঙ্গিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে দেখা যায় দুর্ঘটনার জন্য স্টেশনের ইনচার্জ স্টেশন মাস্টার জাফর উল্লাহ মজুমদার জিআর-১৮৫ থেকে ১৯৪ বিধি ভঙ্গের জন্য এবং অন ডিউটি স্টেশন মাস্টার গ্রেড-৪ ষোলশহর তান্নী বড়ুয়া জিআর-২৫৫ এর (ক) ও (খ) বিধি ভঙ্গের জন্য ৭০ শতাংশ এবং ১৩৪ নং শাটল ট্রেনে কর্মরত লোকোমাস্টার মুন্সি মোঃ রাসেল, টিকিট নং-৫৮১, পাহাড়তলী লোকোসেড এবং সহকারী লোকোমাস্টার জসিম উদ্দিন, টিকিট নং ৭৮৫, পাহাড়তলী লোকোসেড জিআর ৬ এর (অ) ও (আ) ভঙ্গের জন্য ৩০ শতাংশ দায়ী। 

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান অন ডিউটি স্টেশন মাস্টার গ্রেড ৪ তান্নি বড়ুয়া যদি স্টেশন ওয়ার্কিং রুলের ক্রমিক নং-১৫ মোতাবেক সন্টিং কার্যক্রম পরিচালনা করতেন এবং আগত ১৩৪ নং শাটল ট্রেনটিকে ডাউন আউটার সিগনালের বাইরে নিয়ন্ত্রন করে সান্টিং কার্যক্রম পরিচালনা করতেন এবং জাফর উল্লাহ মজুমদার যদি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিক ভাবে মনিটরিং করতেন তাহলে এই দুর্ঘটনাটি এড়ানো সম্ভব হতো। একইভাবে ১৩৪ নং ট্রেনে কর্মরত লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টার যদি জিআর ৬ (অ) ও (আ) অনুসরণ পূর্বক ট্রেনটিকে আউটার সংকটের বাইরে নিয়ন্ত্রন করতেন এবং আউটার ও হোম সিগন্যাল বিপদজনক থাকা সত্ত্বেও ও তিনি আউটার সিগন্যাল ট্রেনটি থামাতেন তাহলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। 

তদন্ত প্রতিবেদন পর্যলোচনা করে দেখা যায় স্টেশন মাস্টার গ্রেড ২ এর দায়িত্বে এস এম গ্রেড ৩ জাফর উল্লাহ মজুমদার স্টেশন ওয়ারকিং রুল এর অনুচ্ছেদ ২৩ অনুযায়ী জি আর ১৮৫  হতে ১৯৪ এবং এর আনুষঙ্গিক নিয়ম অনুযায়ী তার স্টেশনের জন্য দায়ী থাকবেন বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও তিনি তা পালন করতে ব্যার্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সুতরাং এস এম গ্রেড ২ এর দায়িত্বে নিয়োজিত এস এম গ্রেড ৩ জাফর উল্লাহ মজুমদার তার দায়িত্বের অবহেলার জন্য দায়ী। 

দুর্ঘটনার সময়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করে জাফর উল্লাহ মজুমদার প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, দ্বৈত দায়িত্ত্ব পালনের কারণে আমি সময়মতো স্টেশন আঙিনায় থাকতে পারেনি।   

তদন্তে দায়ী প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে কিভাবে জাফর উল্লাহ কে পদোন্নতি দেওয়া হলো তা জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) এ এস এম শাহনেওয়াজ প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, ব্যবস্থা নিতে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়, সময় লাগে। তবে পূর্ণাঙ্গ চার্জশিট পেলে দ্রুতই বিষয়টি দেখবো। আপনি একক অর্ডারে এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে কেন পদোন্নতি দিলেন এমন প্রশ্নে কোন উত্তর দেননি তিনি।